মোঃ ইকরামুল হক রাজীব ক্রাইম রিপোর্টার

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত উপকূলীয় এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম বৃহত্তর এবং ঝুকিপূর্ণ এলাকা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা। দিন দিন জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারনে সৃষ্ট ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে অত্যন্ত ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাগেরহাটের এ উপজেলার জনজীবন।দুর্যোগপ্রবণ এই এলাকা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে টেকসই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কবে নেয়া হবে তা নিয়ে প্রতিনিয়তো উদ্বেগ বাড়ছে জনমনে।এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ তৈরি হয়েছে, যা ঘনীভূত হয়ে ধাপে ধাপে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিচ্ছে।এটি আগামী ২৬ মে সরাসরি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়টি যদি জোয়ারের সময় উপকূলে আঘাত হানা শুরু করে, তবে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।এতে করে ঘূর্ণিঝড়’ রেমাল ‘নিয়ে নতুন করে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে মোরেলগঞ্জের উপকূলবাসী,অরক্ষিত ঝুঁকিপূর্ণ ভেড়িবাঁধ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ।তাই উপকূলীয় এ জনপদের মানুষের কাছে আতঙ্কের মাস মে। গত কয়েক বছরে একাধিক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না পারা মোরেলগঞ্জ উপজেলাবাসী প্রতি বছর এই মাসে অরক্ষিত উপকূল রক্ষা ভেড়িবাঁধ নিয়ে শঙ্কায় থাকেন।সন্ন্যাসী থেকে ঘষিয়াখালী পর্যন্ত মোট ৯৫ কিলোমিটার টেকসই
ভেড়িবাঁধ না থাকায় প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্নিঝড় ইয়াস,আম্ফান এর ফলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো পানগুছী নদীর তীরবর্তী প্রায় ২৫ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।এখনও এর রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি এ অঞ্চলের মানুষ। উপকূলীয় অঞ্চল এ উপজেলা আবার নতুন করে প্লাবিত হলে ১৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে পানগুছি নদীর তীরবর্তী মোরেলগঞ্জ পৌর শহরের ফেরীঘাট সংলগ্ন এলাকা, বারইখালীর কাশ্মীর, বলইবুনিয়ার শ্রেণীখালী, বহরবুনিয়ার ফুলহাতা, ঘষিয়াখালী, মোরেলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের গাবতলা গ্রাম।এছাড়াও ব্যাপক ঝুঁকিতে থাকবে এসব অঞ্চলের বসতবাড়ি ও হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি।এ বিষয়ে মোরেলগঞ্জের কৃষক আব্দুর রহমান আলী বলেন,এতকাল যত দুর্যোগ এসেছে, অধিকাংশ মে মাসে। এ কারণে মে মাস এলে আতঙ্কে থাকি আমরা। ঘূর্ণিঝড় না হলেও এ সময় নদীর পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়ে আমাদের ফসলি জমি তলিয়ে যায়, এতে করে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হই আমরা।ঘূর্ণিঝড় “রেমাল ” আসার খবরে আমরা চিন্তিত, যে কোন সময় নদীরপাড়ের ঝুঁকিপূর্ন ভেড়িবাধটি ভেঙে গিয়ে আমাদের ফসলের ক্ষতি হতে পরে এমন শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছি।এদিকে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি বহুদিনের বলে জানান এ উপজেলার ভুক্তভোগী পানগুছি নদীরপাড় সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার কয়েক শতাধিক মানুষ ।তারা বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের জানালেও তারা শুধু আশ্বাস দেন। পরিকল্পিত ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় প্রতি বছর ভাঙন দেখা দেয়। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলতিই দায়ী। কারণ যখন জোয়ারের পানি বাঁধ উপচে পড়ার উপক্রম হয় তখন স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এলাকাবাসী। এ সময় বাঁধ মেরামতে উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে একদিকে কাজের ব্যয় বাড়ে, অন্যদিকে এসব কাজ হাত ঘুরে নিম্নমানের হয়।তাছাড়া এ অঞ্চলে চিংড়ি চাষের কারণে যথেচ্ছভাবে বেড়িবাঁধ কাটাছেঁড়া করা হয়। চিংড়িচাষীরা বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে কৃষিজমিতে নোনা পানি তোলেন। এতে বাঁধ মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণে বাঁধ টিকছে না বলেও জানান অনেকে।এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সম্প্রতি উপকূলের এ উপজেলার মানুষ লবণ পানির চিংড়িঘেরের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছেন।তাছাড়াও সন্যাসী থেকে ঘষিয়াখালী পর্যন্ত কাটাখাল গুলোতে পর্যাপ্ত স্লুইস গেইট না থাকায় লবণ পানির আগ্রাসনের স্বীকার হচ্ছেন এ অঞ্চলের কয়েক হাজার সাধারন কৃষক।বিগতো দিনে বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আবু মিয়া জানান,’ঝড়ের চেয়ে আমাদের বড় ভয় ভেড়িবাঁধ। উপকূল সুরক্ষায় অর্ধশত বছরের আগে নির্মিত বেড়িবাঁধ এখন আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না। আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো কোনো রকমে টিকে আছে।টেকসই ভেঁড়িবাধ নির্মান কাজের প্রকল্পের বরাদ্দ ২০১৭ সালের দিকে প্রস্তাবনা করা হলেও এখনও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি স্থানীয় সরকারের প্রকৌশল ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা।আংশিক কিছু জায়গায় নামে মাত্র ভেড়িবাধ সংস্কার করা হলেও বেশিরভাগই রয়ে গেছে অরক্ষিত।টেকসই, মজবুত বাঁধ নির্মাণের জন্য কত শত, হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, নকশা হয়েছে, কত কত প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস পেয়েছেন এসব অঞ্চলের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। আর প্রতিবার ঘূর্ণিঝড়ের পর বাঁধ মেরামত ও সংস্কারের নামে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে কত অর্থের অপচয় হয়েছে তার কোনো শেষ নেই। তবে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা পরবর্তী সময়ে ভবিষ্যত ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ‘কোস্টাল এমব্যাকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ (সিইআইপি) গ্রহণ করে।এর আওতায় গণমানুষের দাবীর প্রেক্ষিতে পানগুছি নদীর তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেয় সরকার।পানগুছি নদীর ভাঙন থেকে বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলা সদর ও সংলগ্ন এলাকা সংরক্ষণ ও বিষখালী নদী পুনঃখনন শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ৫২ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন কাজ করা হবে মর্মে ব্যয় ধরা হয় ৬৫৯ কোটি টাকা। এই টাকায় ১০ কিলোমিটার নদীর তীর প্রতিরক্ষা বাঁধ, এক কিলোমিটার মেরামত, বিষখালী নদীর ২৩ কিলোমিটার পুনঃখনন ও ৫টি খাল পুনঃখনন করার কথা থাকলেও সে কাজ এখনও সম্পন্ন করতে পারি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরটি।সে প্রকল্পের আওতায় সন্যাসী থেকে ঘষিয়াখালী পর্যন্ত টেকসই ভেড়িবাধের কাজ হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু সেটিও আর হয়নি

পোস্টটি শেয়ার করুনঃ