৬ দশক আগে বেদখল হওয়া সম্পত্তি ফিরে পেতে চায় ভূক্তভোগীরা।
ছয় দশকেরও বেশি সময় আগে বেদখল হওয়া পৈত্রিক সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্য ভূক্তভোগীরা ঘুরছেন বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে। ১৯৫৬ সালের দিকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার হলতা গুলিশাখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ হলতা গ্রামের ২৬ একরের বেশি জমি দখলে নিয়ে এ সেখান থেকে এর উত্তরাধীকারীকে তাড়িয়ে দেয় অবৈধভাবে জমির দখলদারেরা। ওই জমির বৈধ উত্তরাধীকারী আল আমীন হাওলাদার জানান, তার বাবার দাদা হামেজ উদ্দিন বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ক্রয় করে দক্ষিণ হলতা মৌজার ২৬ একরের বেশি জমি ভোগদখল করছিল। আর সেখানেই স্ত্রী আছিয়া বেগম, ছেলে আব্দুল গফুর ও দুই মেয়ে নিয়ে বাস করত হামেজ উদ্দিন। এ সময় বাড়ির কাজের জন্য আব্দুল বারেছ, আব্দুল ওয়াহেদ, আব্দুল ওয়ারেস এবং আব্দুল খালেক নামের তিন ব্যক্তিকে তার বাড়িতে আশ্রয় দেয় সে। তবে হামেজ উদ্দিন ১৯৩৮ সালের দিকে মৃত্যুবরণ করার পর বারেছ, ওয়াহেদ, ওয়ারেস এবং খালেক জোর করে ওই বাড়ি থেকে হামেজ উদ্দিনের ছেলে গফুর ও দুই মেয়েকে জোর করে সেখান থেকে বের করে দেয়। এরপর গফুর পার্শবর্তী হোগলপাতি গ্রামে শ^শুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। মৃত্যুর পর তাকে শ^শুর বাড়িতেই কবর দেওয়া হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের দিকে গফুরের দুই ছেলে মোঃ মোস্তফা হাওলাদার এবং জামাল হাওলাদার পৈত্রিক ভিটায় ঘর তুলে বসবাস করতে গেলে, অবৈধভাবে জমির দখল নেওয়া বারেছ ও খালেক তাদেরকে সেখান থেকে মারধোর করে তাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে তারা মঠবাড়িয়া ছেড়ে খুলনায় চলে যায়। এরপর সেখানে রেললাইনের কাছে বস্তিতে মানবেতরভাবে বসবাস করতে শুরু করে। এদের মধ্যে ২০০১ সালে মোস্তফা মারা গেছে। তবে তাদের কেউই পৈত্রিক ভিটায় ফিরতে পারেনি। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে অবৈধভাবে জমির দখলদাররা এর আরএস এবং এসএ রেকর্ড কৌশলে নিজেদের নামে নিয়ে নেয়। এমনকি কিছু জমির ভূয়া দলিলও তৈরি করে তারা।
তবে ২০০৫ সালের দিকে গফুরের স্ত্রী চানবরু মারা যাওয়ার আগে জানান যে, মঠবাড়িয়াতে তাদের জমি রয়েছে। সে নিজেও ছোট ছেলে জামালকে নিয়ে ওই গ্রামে গিয়ে জমির মালিকানা দাবি করার পর গুলিশাখালী ইউনিয়নের তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পারুল আলম কাগজপত্র দেখে জমির সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। তবে সে সিদ্ধান্ত মানেনি অবৈধভাবে জমির দখলে থাকা ব্যক্তিরা। এরপর ২০১৪ সাল থেকে মোস্তফার ছেলে আল আমীন সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে জমির সকল দলিল ও অন্যান্য প্রমানাদি সংগ্রহ করেন।
আল আমীন জানান, দক্ষিণ হলতা মৌজার জেএল নং- ৬২ এর এসএ দাগ নং- ২৭৮৫, ২৭৮৬, ২৭৮৭, ২৭৯০, ২৭৯২, ২৭৯৩, ২৭৯৫, ২৭৯৬, ২৭৯৭, ২৮০২, ২৮৭৫ এবং ১২৪, ১২৫, ১২৬, ১৩৯, ১৪০, ১৪১, ১৪২ ও ১৪৩ নং খতিয়ানের জমির উত্তরাধীকারী হামেজ উদ্দিন এর উত্তরসূরীরা। তবে বারেছ, ওয়াহেদ, ওয়ারেস এবং খালেক এর ওয়ারিসরা জমিগুলো জোরপূর্বক দখলে রেখেছে। তবে তাদের কাছে জমির মালিকানার বিষয় জানতে চাইলে কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি বলে জানান আল আমীন। নিজস্ব জমি থাকার পরও ছোট বেলা থেকে ছিন্নমূল হিসেবে খুলনায় বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়েছে বলে জানান আল আমীন। সবশেষ নানা বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে সেখানেই বড় হয়েছে সে।
অবৈধভাবে জমির দখলে থাকা আব্দুল বারেছ এর ছেলে নূর হোসেন জানান, তাদের পূর্ব পুরুষরা ওই জমি ভোগদখল করত। এরই ধারাবাহিকতায় তারাও সেই জমি ভোগদখল করছে। তবে তার কাছে ভোগদখলীয় জমির কোন দলিল নাই বলেও স্বীকার করে নূর হোসেন।
বেদখল হওয়া জমির উত্তরাধীকারী জামাল হাওলাদার জানান, তাদের নিজস্ব জমি থাকার পরও ভূমিহীন হিসেবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। “আমরা কতটা কষ্টের মধ্যে আছি তা বলে কাউকে বুঝাতে পারবো না,” আবেগতাড়িত কষ্ঠে এভাবেই নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেন জামাল।
ওই জমির আরেক উত্তরাধীকারী ফিরোজ জানান, তার নানী মারা যাওয়ার পর তাকে তার জামাই বাড়িতে দাফন করতে হয়েছে।
“আমাদের নিজেদের জমি থাকার পরও সেখানে মৃতদেহ দাফনের কোন সুযোগ নাই। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে এটাও কি সম্ভব?” এভাবেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফিরোজ।
মিনারা নামে ওই জমির আরেক উত্তরাধীকারী জানান, একটি দূর্ঘটনায় সে তার একটি পা হারিয়েছে। বর্তমানে অনেকটাই ভিক্ষাবৃত্তি করে তার সংসার চলে। তবে সে তার জমিতে ফিরতে পারলে এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো না বলে জানায় মিনারা।
অসহায় এই পরিবারগুলোর বেদখল হওয়া জমি ফিরিয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।